সর্বশেষ রমাদান

Omar SaeedOmar Saeed
4 min read

ঘটনাটি আমার কৈশোরের, আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি। রমাদান মাস শুরু হয়েছে। খুব উৎসাহ নিয়ে রোজাগুলো রাখা শুরু করি। ইবাদাত-বন্দেগীতে সাময়িক আগ্রহী হয়ে উঠলেও, ছয় সাত রমাদান পেরোতেই ইবাদাতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলাম নফসের দাসত্বে। কারণ আমার নিয়ত তো ছিল টেনেটুনে এই রমাদানটাই একটু ইবাদত করা। তাই রমাদানের মূল অনুভূতিটা ধরে রাখতে পারিনি। সালাত ও সেহরি-ইফতারের মধ্যেই ইবাদত সীমাবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। তবুও বড়দের শাসনে জামাতে সালাত আদায় করতাম।

এদিকে গ্রামের এক বন্ধু ইব্রাহিমকে গ্রামে আসা যাবৎ দেখতে পায়নি। দেখতে দেখতে শেষ দশ রমাদান ঘনিয়ে এল। মহল্লার মসজিদে ইতিকাফ থাকতে হবে। এবার ইতিকাফ থাকবে দুজন। একজন বড় ভাই আর আরেকজন হলো ইব্রাহিম। দেখে আমি খানিকটা অবাক হলাম। তখন ভাবতাম, ইতিকাফ থাকা বড়দের দায়িত্ব, সেখানে দেখি ইব্রাহিম এগিয়ে আসল। আমার ইতিকাফ থাকা নিয়ে কৌতুহল বৃদ্ধি পেল। তাই প্রতিবার মসজিদে গেলে তার সাথে কথা বলতাম,খোশগল্প করতাম। তাকে বরাবরই ইবাদতে নিবিষ্ট একজন কিশোর হিসেবে খুঁজে পেতাম৷ ধীরে ধীরে ছেলেটার এ উদ্যোগে সন্তুষ্ঠ হয়ে গেলাম। মসজিদে থাকতে কোন অসুবিধা হচ্ছে কিনা জিজ্ঞেস করলে সে হাসিমুখে তার স্বাচ্ছন্দের কথা জানাত। আমি মসজিদে ইবাদাতমুখী থাকলেও, বাড়ি এলেই বেমালুম ভুলে বসতাম মসজিদে থাকাকালীন অনুভূতি। তাকে একদিন জিজ্ঞেস করলাম যে, সে এত কম বয়সে এত ইবাদতের দিকে ঝুঁকে পড়েছে কেন? বয়স হলে তো একসময় করা যাবে। জবাবে পাল্টা সে প্রশ্ন করেছিল যে, সেই সময়টা আসবার নিশ্চয়তা আমার কাছে আছে কিনা। আমি স্বভাবতই কোনো জবাব দিতে পারিনি, শুধু পুনরায় তার কুরআন তিলাওয়াতের দিকে তাকিয়ে ছিলাম।

এভাবে একসময় ২৭শে রমাদান চলে এল। মহল্লার প্রায় সবাই এই এক রাতে পুরো বছরের ইবাদত কাযা আদায়ের অপেক্ষায় থাকলেও, তাকে সবসময় রমাদানের প্রতি রাতকেই গুরুত্বের সাথে নিতে দেখতাম, সে রাতেও তার ব্যতিক্রম হল না। সে রাতে তাকে দেখেছিলাম অশ্রুসিক্ত নয়নে রবের দুয়ারে হাত পেতেছে, সাথে শুনতে পেয়েছিলাম তার আকুল ফরিয়াদ বিশ্বজাহানের প্রতিপালকের কাছে। সেই মুহুর্তে মনে হয়েছিল তার দুআর মতো আর কোনো দুআ আমি এত গভীরভাবে উপলব্ধি করিনি। আমি শুধু চোখ বুজে শুনছিলাম, কতক্ষণ শুনেছি মনে নেই।

ঈদের দিন। ভোরে ফজর শেষে বাড়িতে গিয়ে গোসল, খাওয়া-দাওয়া সেরে ঘন্টখানেক পর করে ঈদগাহের দিকে রওনা দিলাম,পথিমধ্যে ইব্রাহিমকে খুজে পেলাম না। এদিকে ঈদের সালাত শেষ হবার মিনিট বিশেক পরই মুশলধারে বৃষ্টি শুরু হল, তখন আমি মাত্রই ঈদগাহ থেকে রাস্তায় বেরিয়েছি। দৌড়ে একটি চায়ের দোকানের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিলাম। এদিকে আমার মন ইব্রাহিমকে খুঁজে না পেয়ে উশখুশ করছে। ছাউনির উপর থেকে গড়িয়ে পড়া বৃষ্টির ফোটা দেখছি, কিছুক্ষণ পর দূর রাস্তায় একজন পথিককে দোকানের দিকে এগিয়ে আসতে দেখলাম। এই ঝুম বৃষ্টিতে কে ঘর ছেড়ে বাহিরে বেরুবে, কিন্তু ক্রমান্বয়ে কাছে আসতেই দেখলাম পথিকটি হলো ইব্রাহিম। তাকে দেখে আমি উল্লাসিত হয়ে কোলাকুলি করলাম,ঈদের দু'আ করলাম। সে জানাল যে আমাকে না পেয়ে সে নিজ বাড়ি চলে যায়। পরে ঝুৃম বৃষ্টি শুরু হলে সে আমি বাড়ি আসিনি জানতে পেরে খুঁজতে বেরিয়েছে। তারপর এক ছাতায় বাড়ি ফিরে এলাম। ঈদের দিন তার সাথে আর দেখাসাক্ষাৎ হয়নি।

পরদিন জানতে পারলাম,সে ঈদের দিন বিকেলে আল্লাহ সান্নিধ্যে চলে গেছে। একটি দুর্ঘটনায় সে দুনিয়ার জীবন ছেড়ে পরপারে যাত্রা করল। ঘটনাটি শুনার পর শোকের প্রচন্ড ধাক্কায় কয়েকমিনিট স্তব্ধ হয়ে ছিলাম। কোন কথা বলতে পারিনি। শোকের ব্যাথা খুব কষ্টে কাটিয়ে উঠে জানযায় ছুটে গেলাম। জানাযা শেষে কবরের এক পাশে দাড়িয়ে ছিলাম। জীবনের প্রথমবার কারো মৃত্যু এত আগে চলে আসবে কল্পনা করিনি। চারপাশে স্বজনদের চাপা কান্নার ভারি পরিবেশটাও কেমন জানি নিশ্চুপ লাগছিল। অন্তরে ভেসে উঠছিল রমাদানের স্মৃতি। যেদিন সে জিজ্ঞেস করেছিল, মৃত্যুর আগে তওবা করার নিশ্চয়তা আছে কিনা……..

জীবনের গল্পের ইতি টেনে এ পর্যায়ে আহমাদ চুপ হয়ে গেল। পড়ন্ত বিকেলে দুজন বন্ধু খেলার মাঠের ছোট্ট একটি টিলার উপর বসে আছে। মিষ্টি রোদ তাদের গায়ে স্নিগ্ধ আলো ফেলেছে। আহমাদের পাশে বসে থাকা নুগাইর চুপ করে বসে আছে। কথাগুলো তার হৃদয়ে গভীর রেখাপাত সৃষ্টি করেছে। সে আনমনে মাঠের ঘাসগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। রমাদান শেষের দ্বারপ্রান্তে চলে এলেও সে আল্লাহমুখী হওয়ার কথা ভাবেনি। আগের মতই গুনাহের মধ্যে ডুবে ছিল। ভাবনার সাগরে আজ নতুন করে উত্তাল ঢেউ উঠেছে। সে যেন নতুন করে উপলব্ধি করতে পারছে আসলে মৃত্যু জিনিসটা কি। আহমাদ আবার বলতে শুরু করল।

-নুগাইর, গল্পটা এই সময়ের মতই পবিত্র একটি রমাদান অতিক্রম করা এক কিশোরের শেষ জীবনের গল্প। সে হয়ত পবিত্র মাসের সাথে নিজের অন্তরকেও পবিত্র করতে পেরেছিল(আল্লাহ তাকে জান্নাত নসিব করুক)। কিন্তু আমরা কি এই মাসটাকে যথাযথভাবে কাজে লাগাচ্ছি?

-আসলেই তো…..নুগাইর নিচু স্বরে জবাব দিল।

-আজ দেখতে দেখতে ছাব্বিশটি রমাদান পার হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা কতটুকুই-বা আল্লাহরমুখী হতে পেরেছি? আমাদের মৃত্যু কখন আসবে জানি না, জানি না ইব্রাহিমের মত হবে কিনা। যদি জানা না-ই থাকে,তবে সময় থাকতে আখিরাতের পাথেয় সংগ্রহ করছি না কেন? দুনিয়ার জীবনকে শুধু ভোগ করতে করতে যদি হায়াত ফুরিয়ে আসে, তবে কি থাকবে আমার সমগ্র জীবনে আল্লাহর অবাধ্যতা বাদে? তাই চল, ফিরে আসি আল্লাহ'র পানে। সেই পথেই চলার মাঝে রয়েছে আল্লাহ'র সন্তুষ্টি, যেই পথের সমাপ্তি হবে জান্নাতের মনোরম উদ্যানে। ইন শা আল্লাহ'

মাগরিবের আজান বাতাসে ভাসছে। আজকের বিকেলটা হয়ত একটু বড়ই ছিল। তারা পরস্পর সালাম বিনিয়ম করে ইফতার করতে বাসার দিকে রওনা দিল। সাথে নুগাইর নিয়ে গেল এক টুকরো পরিশুদ্ধির গল্প।

মাগরিবের ফরজ সালাত শেষে আহমাদ কিছু একটা ভেবে পিছনের কাতারগুলোর দিকে চুখ বুলাল। নুগাইর সালাত পড়ছে। আহমাদের মনে হল তার চোখে সে দেখতে পেয়েছে ফিরে আসবার আকুল আকাঙ্খা। আল্লাহ'র পানে। এই রমাদানে...

1
Subscribe to my newsletter

Read articles from Omar Saeed directly inside your inbox. Subscribe to the newsletter, and don't miss out.

Written by

Omar Saeed
Omar Saeed