Active Listening মানে শুধু শোনা নয় — বরং হৃদয় দিয়ে বোঝা।


বর্তমানে আমাদের একটি খুব কমন সমস্যা হলো, আমরা শুধু বলতে চাই কিন্তু শুনতে চাই না। সবার বলতে চাওয়ার এই প্রবনাতার কারণে আমাদের নানা সময়ে নানান সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সমস্যা হলোঃ সম্পর্ক দুর্বল হয়ে যাওয়া, ভুল বোঝাবুঝি, সমস্যা সমাধানে ব্যর্থতা ইত্যাদি। এই লেখাতে আমি এই বিষয়টি নিয়ে কিছু লেখার চেষ্টা করছি।
🧠 Active Listening আসলে কী?
Active শব্দের অর্থ সক্রিয়, চালু, কর্মক্ষম। এবং Listening শব্দের অর্থ শোনা। এখন আপনি বলতে পারেন শোনার জন্য তো শুধু মাত্র কান খোলা রাখলেই হয়। সক্রিয় বা কর্মক্ষম থাকার কি প্রয়োজন? জি প্রয়োজন আছে, এখানে Active listening অর্থ শুধুই কানে শোনা নয় — বরং আপনার চোখ, মন, মুখ, শরীর সব দিয়ে অংশগ্রহণ করা।
অর্থাৎ অ্যাক্টিভ লিসেনিং (Active Listening) হলো একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ দক্ষতা, যেখানে আপনি শুধু বক্তার কথা শোনেন না, বরং তার কথা, অনুভূতি এবং অঙ্গভঙ্গির প্রতি সম্পূর্ণ মনোযোগ দেন। এর মূল উদ্দেশ্য হলো বক্তার বার্তাটি পুরোপুরি বোঝা এবং তাকে বোঝানো যে আপনি তাকে গুরুত্ব সহকারে শুনছেন ও তার প্রতি সহানুভূতিশীল।
অ্যাক্টিভ লিসেনিং কেন গুরুত্বপূর্ণ?
অ্যাক্টিভ লিসেনিং ব্যক্তিগত ও পেশাগত উভয় ক্ষেত্রেই সফল যোগাযোগের চাবিকাঠি। এর কিছু গুরুত্ব নিচে উল্লেখ করা হলো:
সম্পর্ক মজবুত করে: যখন আপনি কাউকে সক্রিয়ভাবে শোনেন, তখন সে অনুভব করে যে তার কথাকে আপনি গুরুত্ব দিচ্ছেন এবং তাকে সম্মান করছেন। এটি সম্পর্ককে আরও গভীর ও শক্তিশালী করে তোলে, যা আপনার ব্যক্তিগত বা পেশাগত উভয় সম্পর্ক মজবুত করে।
ভুল বোঝাবুঝি কমায়: মন দিয়ে শুনলে কথার মূল অর্থ, বক্তার উদ্দেশ্য এবং তার ভেতরের অনুভূতি বোঝা সহজ হয়। এতে ভুল বোঝাবুঝি হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায় এবং তথ্য সঠিকভাবে আদান-প্রদান হয়।
সমস্যা সমাধানে সাহায্য করে: যখন কোনো সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়, অ্যাক্টিভ লিসেনিং সমস্যার গভীরে যেতে সাহায্য করে। বক্তার সম্পূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ও উদ্বেগের জায়গাগুলো জানতে পারলে সঠিক সমাধান খুঁজে পাওয়া সহজ হয়।
বিশ্বাস ও নির্ভরতা তৈরি করে: একজন অ্যাক্টিভ লিসেনার অন্যদের কাছে নির্ভরযোগ্য বলে বিবেচিত হন। যখন মানুষ জানে যে আপনি তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনবেন এবং বুঝবেন, তখন তারা আপনার প্রতি আস্থা স্থাপন করে।
সহানুভূতি বৃদ্ধি করে: অ্যাক্টিভ লিসেনিং আপনাকে অন্যের অনুভূতি, প্রেক্ষাপট এবং দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে সাহায্য করে, যা আপনার সহানুভূতি (empathy) বাড়িয়ে তোলে।
শিক্ষার সুযোগ তৈরি করে: অন্যদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলে নতুন কিছু শেখার সুযোগ তৈরি হয়। আপনি বিভিন্ন ধারণা, অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান লাভ করতে পারেন।
অ্যাক্টিভ লিসেনার হলে কী কী সুবিধা পাওয়া যায় বা উপকার হয়?
অ্যাক্টিভ লিসেনিং অনুশীলন করলে অনেক সুবিধা পাওয়া যায়, যেমন:
সম্পর্ক উন্নত হয় : ব্যক্তিগত জীবন এবং কর্মক্ষেত্রে সহকর্মী, বন্ধু, পরিবার ও ক্লায়েন্টদের সাথে আপনার সম্পর্ক অনেক উন্নত হয়। মানুষ আপনার সাথে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
যোগাযোগ কার্যকরী বা ফলপ্রসূ হয় : আপনি স্পষ্ট এবং নির্ভুলভাবে তথ্য গ্রহণ করতে পারেন, যা ভুল যোগাযোগ হ্রাস করে। এতে কাজের গুণগত মান বাড়ে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ আরও সঠিক হয়।
দ্বন্দ্ব নিরসন করে: অ্যাক্টিভ লিসেনিং আপনাকে অন্যের দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে সাহায্য করে, যা বিরোধ বা মতবিরোধ নিরসনে কার্যকর ভূমিকা রাখে। আপনি সমস্যার মূল কারণ চিহ্নিত করতে পারেন।
আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়: যখন আপনি কার্যকরভাবে শুনতে পারেন, তখন আপনার আত্মবিশ্বাস বাড়ে। আপনি বুঝতে পারেন যে আপনি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম।
নেতৃত্ব দানে ভূমিকা রাখে: একজন ভালো শ্রোতা হিসেবে আপনি আপনার দলের সদস্যদের অনুপ্রাণিত করতে পারেন এবং তাদের মধ্যে বিশ্বাস তৈরি করতে পারেন। এটি আপনাকে একজন কার্যকর নেতা হিসেবে গড়ে তোলে।
সমস্যার পূর্বাভাস সনাক্ত করণ: মনোযোগ দিয়ে শুনলে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য সমস্যা বা ঝুঁকিগুলো আগে থেকেই চিহ্নিত করা যায়, যার ফলে সেগুলোর মোকাবিলায় প্রস্তুতি নেওয়া যায়।
মানসিক চাপ হ্রাস পায়: ভালো করে শুনলে একটি বিষয় নিয়ে বারবার জিজ্ঞাসা করা বা ভুল তথ্য নিয়ে কাজ করার প্রয়োজন হয় না, যা মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে।
অ্যাক্টিভ লিসেনিং না হলে কী কী ধরণের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়?
অ্যাক্টিভ লিসেনিং না করলে বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে:
ভুল বোঝাবুঝি ও ভুল তথ্য : মনোযোগ না দিলে কথার ভুল অর্থ হতে পারে, গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বাদ পড়তে পারে বা সম্পূর্ণ ভুল বার্তা পাওয়া যেতে পারে, যা ব্যক্তিগত ও পেশাগত ক্ষেত্রে মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে।
সম্পর্কের অবনতি: মানুষ যদি অনুভব করে যে আপনি তাদের কথা শুনছেন না বা তাদের গুরুত্ব দিচ্ছেন না, তাহলে তারা আপনার সাথে কথা বলা বা তাদের অনুভূতি প্রকাশ করা বন্ধ করে দেবে। এতে সম্পর্কগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে।
বিশ্বাসহীনতা: আপনার কথা মনোযোগ দিয়ে না শোনার অভ্যাস অন্যদের মধ্যে আপনার প্রতি অবিশ্বাস তৈরি করতে পারে। তারা মনে করতে পারে আপনি দায়িত্বজ্ঞানহীন বা উদাসীন।
দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি: ভুল বোঝাবুঝির কারণে প্রায়শই দ্বন্দ্ব ও তর্ক-বিতর্ক বেড়ে যায়। যখন আপনি অন্যের কথা না শুনে নিজের মতো করে প্রতিক্রিয়া দেখান, তখন সংঘাতের সম্ভাবনা বাড়ে।
সিদ্ধান্ত গ্রহণে ত্রুটি: গুরুত্বপূর্ণ তথ্য না জানার কারণে বা ভুল বোঝার কারণে ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে, যার ফলে আর্থিক ক্ষতি বা অন্যান্য নেতিবাচক ফলাফল দেখা যেতে পারে।
উৎপাদনশীলতা হ্রাস: কর্মক্ষেত্রে অদক্ষ যোগাযোগ টিমের সদস্যদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা তৈরি করতে পারে এবং কাজের গতি ও মান কমিয়ে দিতে পারে।
একাকীত্ব ও বিচ্ছিন্নতা: আপনার আশেপাশের মানুষ আপনাকে একজন অসংবেদনশীল ব্যক্তি হিসেবে দেখতে পারে, যার ফলস্বরূপ আপনি নিজেকে একাকী এবং অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন অনুভব করতে পারেন।
কিভাবে Active Listener হওয়া যায়?
১. সম্পূর্ণরূপে মনোযোগ দিন (Pay Full Attention)
বক্তার দিকে মন দিন: যখন কেউ কথা বলছে, তখন তার দিকে সম্পূর্ণ মনোযোগ দিন। মোবাইল ফোন বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক গ্যাজেট থেকে নিজেকে দূরে রাখুন। অন্য কোনো বিষয়ে চিন্তা করা বা মনে মনে জবাব তৈরি করা থেকে বিরত থাকুন।
চোখে চোখ রাখুন: বক্তার চোখে চোখ রেখে কথা শুনুন। এটি বক্তাকে বোঝাবে যে আপনি তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছেন। তবে অতিরিক্ত তাকানো উচিত নয়, মাঝে মাঝে বিরতি দিন।
শারীরিক ভাষা খেয়াল করুন: বক্তার অঙ্গভঙ্গি, মুখের অভিব্যক্তি এবং কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করুন। কারণ, কথার পাশাপাশি শারীরিক ভাষাও অনেক কিছু প্রকাশ করে।
মনোযোগ ধরে রাখুন: কথোপকথনের সময় আপনার মনোযোগ যাতে অন্য দিকে চলে না যায়, সেদিকে খেয়াল রাখুন। প্রয়োজনে ছোট নোট নিতে পারেন, যা আপনার মনোযোগ ধরে রাখতে সাহায্য করবে।
২. আপনি শুনছেন তা দেখান (Show That You Are Listening)
ইতিবাচক অঙ্গভঙ্গি: মাথা নাড়ানো, মৃদু হাসি, এবং বক্তার দিকে সামান্য ঝুঁকে বসা বোঝায় যে আপনি তার প্রতি আগ্রহী।
ছোট শব্দ ব্যবহার করুন: মাঝে মাঝে "হ্যাঁ", "হুম", "বুঝতে পারছি" -এর মতো শব্দ ব্যবহার করে বক্তাকে উৎসাহিত করুন। এতে বক্তা বুঝতে পারবেন যে আপনি সক্রিয়ভাবে শুনছেন।
খোলা দেহভঙ্গি: হাত ভাঁজ করে রাখা বা প্রতিরক্ষামূলক ভঙ্গিতে না থেকে একটি খোলা ও স্বচ্ছন্দ দেহভঙ্গি বজায় রাখুন।
৩. বিচার করা বা বাধা দেওয়া থেকে বিরত থাকুন (Defer Judgment and Don't Interrupt)
সম্পূর্ণ কথা বলতে দিন: বক্তাকে তার কথা শেষ করতে দিন। তার কথা মাঝখানে থামিয়ে দেবেন না, কারণ এতে বক্তা বিরক্ত হতে পারেন এবং তার বার্তাটি সম্পূর্ণভাবে আপনার কাছে নাও পৌঁছাতে পারে।
রায় দেওয়া এড়িয়ে চলুন: বক্তা কথা বলার সময় তার কথার বিচার করা বা নিজের মতামত চাপিয়ে দেওয়া থেকে বিরত থাকুন। আপনার লক্ষ্য হলো বক্তার বার্তাটি পুরোপুরি বোঝা, তার বিচার করা নয়।
৪. প্রতিক্রিয়া দিন এবং প্রশ্ন করুন (Provide Feedback and Ask Questions)
প্যারাফ্রেজ করুন (Paraphrase): বক্তার মূল কথাগুলো নিজের ভাষায় সংক্ষেপে বলুন। যেমন: "আপনি কি বলতে চাইছেন যে...", "আমি যা বুঝলাম তা হলো..."। এতে নিশ্চিত হবেন যে আপনি কথাটি ঠিকভাবে বুঝতে পেরেছেন এবং বক্তাও জানবে যে আপনি তাকে মনোযোগ দিয়ে শুনছেন।
স্পষ্ট প্রশ্ন করুন: যদি কোনো বিষয় অস্পষ্ট থাকে বা আরও জানতে চান, তাহলে স্পষ্ট প্রশ্ন করুন। তবে প্রশ্নগুলো যেন বক্তার দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার জন্য হয়, তাকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য নয়। যেমন: "এই বিষয়ে আপনার অনুভূতি কেমন?" "এরপর কী হলো?"
সারসংক্ষেপ করুন (Summarize): মাঝে মাঝে বক্তার বলা কথাগুলোর একটি সংক্ষিপ্ত সারসংক্ষেপ করুন। এটি কথোপকথনের মূল বিষয়গুলো মনে রাখতে এবং আপনার বোঝার ক্ষমতাকে আরও স্পষ্ট করতে সাহায্য করবে।
৫. সহানুভূতি দেখান (Empathize)
অন্যের দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবুন: নিজেকে বক্তার জায়গায় রেখে তার অনুভূতি এবং অভিজ্ঞতা বোঝার চেষ্টা করুন। তার আবেগগুলোকে যাচাই করুন, এমনকি যদি আপনি তার সাথে সম্পূর্ণ একমত নাও হন।
ভুল ধারণা এড়িয়ে চলুন: বক্তার কথা শুনে কোনো পূর্বানুমান করা বা দ্রুত সিদ্ধান্তে আসা থেকে বিরত থাকুন। প্রতিটি মানুষের অভিজ্ঞতা এবং দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন হতে পারে।
এই কৌশলগুলো নিয়মিত অনুশীলনের মাধ্যমে আপনি একজন অত্যন্ত কার্যকর অ্যাক্টিভ লিসেনার হয়ে উঠতে পারবেন, যা আপনার ব্যক্তিগত ও পেশাগত সম্পর্কগুলোকে আরও মজবুত করবে।
সংক্ষেপে, Active Listening মানে শুধু শোনা নয় — বরং হৃদয় দিয়ে বোঝা। যে শুনতে জানে, সে সম্পর্ক গড়তে পারে, মানুষের মন জয় করতে পারে, এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। অ্যাক্টিভ লিসেনিং একটি শক্তিশালী দক্ষতা যা শুধু আপনার ব্যক্তিগত জীবন নয়, আপনার পেশাগত জীবনেও ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে। এটি একটি শেখার প্রক্রিয়া, এবং অনুশীলনের মাধ্যমে এটিকে আরও উন্নত করা সম্ভব।
Subscribe to my newsletter
Read articles from AL Hasib directly inside your inbox. Subscribe to the newsletter, and don't miss out.
Written by
