“ স্টুডেন্ট লাইফ থেকেই ক্যারিয়ার বিল্ডআপ: শুরুটা হোক আজই ! ”

বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে কেবল ভালো রেজাল্টই সফল ক্যারিয়ারের নিশ্চয়তা দেয় না। একজন স্টুডেন্টের ক্যারিয়ার গঠনের যাত্রা শুধু ক্লাসরুমের ভেতরেই নয় ক্লাসরুমে বাইরে থেকেও শুরু হয়, যখন সে নিজেকে দক্ষ, আত্মবিশ্বাসী এবং পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়। সঠিক পরিকল্পনা, দক্ষতা অর্জন এবং নেটওয়ার্কিং-য়ের মাধ্যমে একজন স্টুডেন্ট একটি সফল ক্যারিয়ারের দিকে এগিয়ে যেতে পারে। আজকের ব্লগে আমি আলোচনা করবো, একজন স্টুডেন্ট কীভাবে তার ক্যারিয়ার বিল্ডআপ করতে পারে।

১. লক্ষ্য নির্ধারণ অর্থাৎ সঠিক ক্যারিয়ার গোল সেট করা

প্রথমেই তোমাকে নির্ধারণ করতে হবে, তুমি ভবিষ্যতে কী করতে চাও, জীবনে কোথাও যেতে চাও, নিজেকে কোন জায়গায় দাড়ঁ করাতে চাও। সেটা স্পষ্ট না হলে প্রস্তুতি নেওয়াও কঠিন।

  • তুমি কি শিক্ষক হতে চাও? ইন্জিনিয়ার,ডেভেলপার নাকি উদ্যোক্তা?

  • বিভিন্ন ক্যারিয়ার অপশন রিসার্চ করো এবং নিজের আগ্রহ, দক্ষতা ও ভবিষ্যতের চাহিদা সব মিলিয়ে একটি গোল সেট করো।

  • SMART Goal পদ্ধতিতে লক্ষ্যের কাঠামো তৈরি করো। SMART Goal হচ্ছে একটি জনপ্রিয় লক্ষ্য নির্ধারণ কৌশল, যা নিশ্চিত করে যে তোমার লক্ষ্যগুলো স্পষ্ট, পরিমাপযোগ্য এবং অর্জনযোগ্য। SMART শব্দটি ৫টি গুরুত্বপূর্ন উপাদানকে নির্দেশ করে:

  • S - Specific (নির্দিষ্ট) : তোমার লক্ষ্যটি পরিষ্কার এবং নির্দিষ্ট হতে হবে।

  • M - Measurable (পরিমাপযোগ্য) : লক্ষ্যটি এমন হতে হবে যাতে তুমি এটি কতটা অগ্রসর হয়েছো তা পরিমাপ করতে পারো।

  • A - Achievable (অর্জনযোগ্য) : লক্ষ্যটি বাস্তবসম্মত হতে হবে, যাতে তুমি সেটি অর্জন করতে পারো।

  • R - Relevant (প্রাসঙ্গিক) : লক্ষ্যটি তোমার জীবনের বড় কোনো উদ্দেশ্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হতে হবে।

  • T - Time-bound (সময়সীমা নির্ধারিত) : লক্ষ্যটি অর্জনের জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা থাকতে হবে।

২. টাইম ম্যানেজমেন্ট ও সেলফ্ কেয়ার

সফলতার জন্য টাইম ম্যানেজমেন্টের পাশাপাশি শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা খুবই জরুরি। শুধু পরিশ্রম আর মেধা দিয়েই দীর্ঘমেয়াদে সফল হওয়া সম্ভব নয়, যদি শরীর ও মন ঠিক না থাকে।

  • ডেইলি রুটিন মেইনটেইন করো। রুটিন অনুযায়ী সময়ের কাজ সময়ে শেষ করো।

  • পর্যাপ্ত ঘুম যাও। প্রতিদিন কমপক্ষে ৬-৮ ঘন্টা ঘুমাও। ঘুম মস্তিস্ক পুনরুদ্ধার করে এবং মানসিক চাপ কমায়।

  • প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট ব্যায়াম করো।

  • প্রতিদিন কিছু সময় মেডিটেশন করো। মেডিটেশন মনোযোগ বাড়ায়, আত্মচিন্তা বৃদ্ধি ও আত্মনিয়ন্ত্রন বৃদ্ধি করে, মানসিক প্রশান্তি বাড়ায়।

তুমি যদি টাইম ম্যানেজমেন্ট ও নিজের যত্ন না নাও, সফলতা তোমার কাছে এসে দীর্ঘকাল থাকবে না ”

৩. একাডেমিক উন্নয়ন

ভালো রেজাল্ট তোমার ক্যারিয়ারের প্রথম ধাপ এবং চাকরির দরজায় প্রথম ধাক্কা। অনেক কোম্পানি একাডেমিক পারফরম্যান্স দেখে শর্টলিস্ট করে। তাই :

  • নিয়মিত স্টাডি রুটিন মেইনটেইন করো।

  • প্রতিদিনের পড়াশোনাকে গুরুত্ব দাও।

  • সময়মতো ক্লাস করো, প্রশ্ন করো এবং নিজের থেকে কিছু জানার চেষ্টা করো।

  • প্রজেক্ট ও অ্যাসাইসমেন্টে এক্সট্রা এপোর্ট দাও।

  • শিক্ষকদের সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলো।

  • প্রয়োজনে রেফারেন্স বই, অনলাইন রিসোর্স ব্যবহার করো।

তবে শুধু মুখস্ত বিদ্যা নয়, বুঝে পড়া এবং বুঝে শেখা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন।

৪. স্কিল ডেভেলপমেন্ট

আজকের প্রতিযোগিতামূলক চাকরির বাজারে শুধু ডিগ্রি বা সার্টিফিকেট থাকলেই চলে না। একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি প্রাকটিক্যাল স্কিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিষ্ঠানগুলো এখন এমন কর্মী খুঁজছে যারা বাস্তব জীবনের সমস্যা সমাধান করতে পারে, দলগতভাবে কাজ করতে পারে এবং গতিশীল পরিবেশে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পারে। এজন্য প্রয়োজন বইয়ের বাইরের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা, যা তোমাকে ক্যারিয়ারে এগিয়ে রাখবে। বর্তমান সময়ে টেকনিক্যাল ও সফটৃ স্কিল দুটোই জরুরি।

  • কমিউনিকেশন স্কিল

    • পরিষ্কার ও কার্যকরভাবে কথা বলা, লিখতে পারা এবং শোনার দক্ষতা যেকোনো পেশার জন্য অপরিহার্য।

    • প্রেজেন্টেশন স্কিল, নেগোশিয়েশন এবং আত্মবিশ্বাসীভাবে নিজের মত প্রকাশ করতে পারা চাকরিতে সাফল্য আনবে

  • ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স (EQ)

    • সহকর্মী, ক্লায়েন্ট বা অফিসারদের সাথে সুম্পর্ক বজায় রাখতে EQ গুরুত্বপূর্ণ।

    • মানসিক স্থিতিশীলতা, সহমর্মিতা এবং স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট তোমাকে পেশাদারিত্বে এগিয়ে রাখবে।

  • ক্রিটিক্যাল থিংকিং এবং সমস্যা সমাধান

    • বইয়ের সূত্রের বাইরে গিয়ে বাস্তব সমস্যা বিশ্লেষণ ও সমাধান করার দক্ষতা চাকরিদাতাদের কাছে খুবই মূল্যবান।

    • লজিক্যাল থিংকিং, ডেটা অ্যানালাইসিস এবং ক্রিয়েটিভ সলিউশন দেওয়ার ক্ষমতা তোমাকে আলাদা করে চিহ্নিত করবে।

  • টিমওয়ার্ক ও লিডারশিপ

    • দলগতভাবে কাজ করা, অন্যদের অনুপ্রাণিত করা এবং কনফ্লিক্ট রেজোলিউশনের দক্ষতা অর্জন করা।

    • লিডারশিপ স্কিল তোমাকে ক্যারিয়ারের উচ্চস্তরে নিয়ে যাবে।

  • টেকনোলজি লিটারেসি

    • ডিজিটাল যুগে বেসিক কম্পিউটার স্কিল অতিরিক্ত সুযোগ তৈরি করে।
  • অ্যাডাপ্টিবিলিটি ও লার্নিং মাইন্ডসেট

    • দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে নতুন কিছু শেখার ইচ্ছা এবং পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়ানো গুরুত্বপূর্ণ।

    • সেলফ-লার্নিংয়ের মাধ্যমে নিজেকে প্রতিনিয়ত আপডেট রাখা।

  • প্রোডাক্টিভিটি ও টাইম ম্যানেজমেন্ট

    • কাজের প্রাধান্য নির্ধারণ, ডেডলাইন ম্যানেজ করা এবং ফোকাস ধরে রাখার দক্ষতা তোমাকে আরো ইফিশিয়েন্ট করে তুলবে।

এই স্কিল গুলো তোমার ক্যারিয়ারে বড় একটি প্রভাব ফেলবে। বইয়ের জ্ঞান তোমাকে ভিত্তি দেবে, কিন্তু বাস্তব জীবনের দক্ষতাই তোমাকে সাফল্যের শীর্ষে পৌছেঁ দেবে।

“শিক্ষা শুধু ক্লাসরুমেই হয় না–-জীবনই সবচেয়ে বড় স্কুল।”

৫. এক্সট্রা কারিকুলার এক্টিভিটিজ (ECA)

স্কুল, কলেজ, ইনস্টিটিউট বা ভার্সিটির ক্লাসরুমের শিক্ষা তোমাকে শুধু তাত্ত্বিক জ্ঞান দেবে, কিন্তু এক্সট্রা কারিকুলার এক্টিভিটিজ (ECA) তোমাকে বাস্তব জীবনের জন্য প্রস্তুত করবে। স্কুল, কলেজ, ইনস্টিটিউট বা ভার্সিটির বিভিন্ন ক্লাব ( যেমন:- ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে CST Club , Robotics Club ইত্যাদি) , স্পোর্টস, ওয়ার্কশপ, সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা বা স্টুডেন্ট অর্গানাইজেশনের মাধ্যমে তুমি অনেক কিছু শিখতে পারবে। যেমন -

  • লিডারশিপ

  • টিমওয়ার্ক ও সহযোগিতা

  • টাইম ম্যানেজমেন্ট

  • স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট ও আত্মবিশ্বাস

  • সমস্যা সমাধানের কৌশল ইত্যাদি।

“এক্সট্রা কারিকুলার এক্টিভিটিজ তোমাকে কমপ্লিট প্রফেশনাল করে গড়ে তুলবে!”

৬. নেটওয়ার্কিং

নেটওয়ার্কিং ক্যারিয়ারে অনেক বড় রোল প্লে করে।“ আপনার নেটওয়ার্কই আপনার নেট ওয়ার্থ ” – এই কথাটি আজকের ক্যারিয়ার ওয়ার্ল্ডে শতভাগ সত্য। একাডেমিক রেজাল্ট বা স্কিলসের পাশাপাশি স্ট্র্যাটেজিক নেটওয়ার্কিং তোমার চাকরি, ইন্টার্নশিপ, মেন্টরশিপ এমনকি ভবিষ্যৎ ব্যবসার অনেক সুযোগ এনে দিতে পারে। বর্তমান চাকরি বাজারে ৮০% চাকরি ফর্মাল পোস্টিং ছাড়াই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ফিলআপ হয়। সঠিক মেন্টর তোমাকে ৫ বছর এগিয়ে দিতে পারে শুধু একটি সঠিক পরামর্শ ‍দিয়ে। তাই,

  • সবসময় অ্যালামনাই বা সিনিয়র এবং শিক্ষকদের সাথে কানেক্ট থাকা। সিনিয়র ব্যাচমেট, অ্যালামনাই বা টিচার্সের রেফারেন্স তোমার জন্য অটোমেটিক শর্টলিস্টিং নিশ্চিত করতে পারে।

  • সেমিনার, ওয়ার্কশপ ও জব ফেয়ারে যোগ দেওয়া।

  • LinkedIn প্রোফাইল অপটিমাইজ কর। যেখানে তুমি জানতে পারবে যে, কোন সেক্টরে স্কিল ডিমান্ড বাড়ছে?, কোন সেক্টরের ভবিষ্যৎ চাহিদা কেমন?, কোন কোম্পানির হায়ারিং প্রসেস কীভাবে কাজ করে? এবং স্যালারি নেগোশিয়েশনের টিপস্ ইত্যাদি।

“নেটওয়ার্কিং হলো একটি লং-্টার্ম ইনভেস্টমেন্ট – আজ যে বীজ তুমি রোপণ করছো, তা ভবিষ্যতে তোমাকে ক্যারিয়ারের গাছ হয়ে ফল দেবে।”

৭. আত্মউন্নয়ন ও আত্মবিশ্বাস গঠন

“আত্মবিশ্বাস হচ্ছে সাফল্যের প্রথম সিঁড়ি” – কিন্তু এটি রাতারাতি তৈরি হয় না। আত্মউন্নয়ন একটি চলমান প্রক্রিয়া, যার জন্য প্রয়োজন সচেতন প্রচেষ্টা, আত্ম-বিশ্লেষণ এবং ধারাবাহিকতা।

  • নিজেকে জানো, নিজের ভুল গুলো নির্ণয় করো এবং সেখান থেকে শিখো, নিজের শক্তি ও দুর্বলতা গুলো চিহ্নিত করো এবং সেগুলো উন্নত করো।

  • মোটিভেশন বা journaling শুরু করো। ‍নিজেকে নিজে মোটিভেট করো, নিজের জন্য নিজেই আলো হও। ‍Self-motivation যেকোনো পরিস্থিতি মানিয়ে নিতে সহায়তা করে, নিজেকে শক্ত করে এবং আত্মবিশ্বাস গঠন করে।

“আত্ম বিশ্বাস হচ্ছে তখন, যখন তুমি নিজের দুর্বলতাকে জানো কিন্তু তারপরও এগিয়ে যাও।”

“তুমি যদি নিজের উপর বিশ্বাস রাখো, তাহলে সফলতা তোমার দরজায় আসবেই।”

৮. লং টার্ম প্লানিং

স্টুডেন্ট লাইফ থেকে ক্যারিয়ার বিল্ডআপের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো শর্ট টার্ম গোলের পাশাপাশি লং টার্ম প্ল্যান তৈরি করা।

  • ৫ বছর পর নিজেকে কোথায় দেখতে চাও?

  • ৫ বছর পর তোমার ইন্ডাস্ট্রির কি কি চাহিদা বাড়বে, কি কি চাহিদা কমবে এবং সেই অনুযায়ী নিজেকে আপডট করো। ইন্ডাস্ট্রির চাহিদা অনুযায়ী নিজের দক্ষতা বাড়ায়, যেন ৫ বছর পর ইন্ডাস্ট্রির কোনো বড় পরিবর্তন হলেও ইন্ডাস্ট্রি তোমাকে চায়।

  • উচ্চ শিক্ষা ( যেমন- Bsc, Msc, PhD) বা সমমানের কোর্সের প্ল্যান তৈরি কর।

৯. ধৈর্য্য ও পজিটিভ অ্যাটিচিউড

ক্যারিয়ার জার্নি কখনো সরল রেখার মতো হয় না – এতে উত্থান-পতন, চ্যালেঞ্জ ও অপ্রত্যাশিত বাঁক থাকবেই। ধৈর্য্য ও পজিটিভ অ্যাটিচিউড তোমাকে দীর্ঘমেয়াদে সফল হতে সাহায্য করবে।

  • ব্যর্থতাকে লার্নিং অপর্চুনিটি হিসেবে নাও। প্রতিটি ব্যর্থতা তোমাকে নতুন কিছু শেখাবে।

  • কনস্ট্যান্টলি লার্নিং চালিয়ে যাও। ইন্ডাস্ট্রি ট্রেন্ডস আপডেটেড রাখো, নতুন দক্ষতা অর্জন করো।

  • পজিটিভ কমিউনিটি বিল্ড কর। নেগেটিভ বা টক্সিক লোকদের থেকে দূরে থাকো এবং ইতিবাচক ও পজিটিভ মানুষের সাথে কানেক্ট থাকো।

“যদি তুমি ধৈর্য্য হারাও, তাহলে তুমি যুদ্ধে হারবে !”

একজন স্টুডেন্ট হিসেবে তোমার হাতেই রয়েছে অসীম সম্ভাবনা। সঠিক প্ল্যানিং, স্কিল ডেভেলপমেন্ট ও নেটওয়ার্কিং ইত্যাদির মাধ্যমে একটি সফল ক্যারিয়ার গড়ে তুলতে পারো। ক্যারিয়ার গড়ার জন্য বড় কোনো কিছু করতে হবে — এমন না। বরং ছোট ছোট পদক্ষেপই বড় পরিবর্তন আনে।

  • আজ একটু বেশি শিখো

  • আজ একটি নতুন স্কিল শেখো

  • আজ একটি নতুন সম্পর্ক গড়ো

ক্যারিয়ার গঠনের যাত্রা এখনই শুরু হতে পারে — শুধু প্রয়োজন একটি সাহসী ‘শুরু’।

“The best time to start was yesterday. The next best time is NOW.”

0
Subscribe to my newsletter

Read articles from Shakhawat Hossain directly inside your inbox. Subscribe to the newsletter, and don't miss out.

Written by

Shakhawat Hossain
Shakhawat Hossain