মাইগভ: এক প্ল্যাটফর্মে সরকারি সেবা

পাবনার আতাইকুলা গ্রামের আশরাফ আলী। বয়স প্রায় পঞ্চাশ। জমির খতিয়ান ঠিক করা, নাতির জন্মনিবন্ধনের ভুল সংশোধন, কৃষি প্রণোদনার আবেদন—এসব নিয়েই বছরের পর বছর ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা, জেলা শহর ঘুরে বেড়াতে হয়েছে। কোথাও ফর্ম ছিল না, কোথাও অফিস বন্ধ, কোথাও আবার অফিসারের দেখা মিলত না। এবার কৃষি প্রণোদনার জন্য অনলাইনে ফরম পূরণের কথা শুনে দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। তখন পাশের গ্রামের করিম এসে বলল, ‘চাচা, এখন মাইগভ আছে। চলুন, ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে গিয়ে আবেদন করি।’

আশরাফ আলী প্রথমে দ্বিধায় ছিলেন। পরে করিমের সঙ্গে সেখানে গেলেন। মিনিট কয়েকের মধ্যে মাইগভ অ্যাকাউন্ট খোলা হলো। কৃষি প্রণোদনার আবেদন ফরম পূরণ করে জমা দেওয়া হলো। মোবাইলে নোটিফিকেশন এল—‘আপনার আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে।’ আশরাফ আলী বুঝলেন, অফিসে ঘুরে ঘুরে সেবা নেওয়ার বদলে এখন কয়েক মিনিটেই অনলাইনে আবেদন করা যায়।

ঢাকার মিরপুরের রিফাত হোসেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ছোট্ট অনলাইন ব্যবসা শুরু করতে চান। এজন্য প্রয়োজন ট্রেড লাইসেন্স। তিনি আগে শুনেছিলেন ট্রেড লাইসেন্স নিতে হলে পৌরসভার অফিসে ঘোরাঘুরি করতে হয়, ব্যাংকে টাকা জমা দিতে হয়। রিফাত এ যুগের ছেলে, তিনি এখন জানেন, এসব ঝামেলা ছাড়াই ঘরে বসে ট্রেড লাইসেন্সের জন্য আবেদন করা যায়। রিফাত সরাসরি গেলেন www.mygov.bd ওয়েবসাইটে। মোবাইল নম্বর ও জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করলেন।
‘সেবা’ বিভাগ থেকে ‘ট্রেড লাইসেন্স আবেদন’ ফর্ম খুঁজে নিয়ে তথ্য পূরণ করলেন, অনলাইনে ফি পরিশোধ করলেন। কিছুদিনের মধ্যেই ইমেইলে ট্রেড লাইসেন্সের সফটকপি পেয়ে গেলেন। এই পরিস্থিতির পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন ছিল একটি সমন্বিত ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের। সেই প্রেক্ষাপটে তৈরি হয়েছে মাইগভ

মাইগভ হলো:

  • একক ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, যেখানে নাগরিকরা সরকারি সেবা পেতে পারেন,

  • একবার রেজিস্ট্রেশন করলেই সব সেবায় প্রবেশাধিকার পাওয়া যায়,

  • আবেদন ফরম পূরণ, ফি পরিশোধ, ডকুমেন্ট আপলোড, আবেদন ট্র্যাকিং—সব কিছু অনলাইনে সম্পন্ন হয়।

বর্তমানে মাইগভ প্ল্যাটফর্মে ১,৮০০টিরও বেশি সেবা যুক্ত হয়েছে—শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, বাণিজ্য, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণসহ প্রায় প্রতিটি বড় খাতের সেবা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

গ্রামে বা শহরে, যার হাতে স্মার্টফোন অথবা যার কাছে কম্পিউটার আছে—সবার জন্য সেবা এখন উন্মুক্ত। যাদের নেই, তারা ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার বা তথ্যকেন্দ্রের মাধ্যমে সহায়তা নিতে পারেন।

এর বাইরে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের উদ্যোগে ১০০-রও বেশি সরকারি সেবা নিয়ে চালু হচ্ছে ‘নাগরিক সেবা বাংলাদেশ’ নামে একটি নতুন আউটলেট। চলমান ডিজিটাল সেন্টারগুলোকেও এতে যুক্ত করা হবে। সেখানেও পাওয়া যাবে উল্লিখিত সেবাটি।

মাইগভ প্ল্যাটফর্মের কিছু বৈশিষ্ট্য:

  • স্ক্রিন রিডার সাপোর্ট

  • টেক্সট রিসাইজিং

  • ভয়েস কমান্ড সুবিধা—বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন নাগরিক, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ও প্রবীণ ব্যক্তিরাও সহজে ব্যবহার করতে পারেন।

তবে, এখনো কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে:

  • সরকারি সকল সেবা সম্পূর্ণ ডিজিটালাইজ হয়নি,

  • মন্ত্রণালয় ও দপ্তরগুলোর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের প্রয়োজন আছে।

ভবিষ্যতে মাইগভ প্ল্যাটফর্মে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) যুক্ত করে সেবাকে আরও গতিশীল এবং ব্যবহারকারীকেন্দ্রিক করার পরিকল্পনা রয়েছে।

আশরাফ আলী কিংবা রিফাত—এখন তারা দালাল ছাড়া, ভোগান্তি ছাড়া, সরাসরি সরকারি সেবা নিতে পারছেন। মাইগভ এখন আর শুধু একটি ওয়েবসাইট নয়, এটি নাগরিকের অধিকার চর্চার একটি উন্মুক্ত মঞ্চে পরিণত হচ্ছে।

ডিজিটাল বিল পেমেন্ট: সময় বাঁচানোর বাস্তব অভিজ্ঞতা

বছর তিনেক আগের কথা। বেসরকারি চাকরিজীবী বিল্লাল সকালে নাশতা করছিলেন। ৬০ বছর বয়সী অবসরপ্রাপ্ত বাবা আশরাফ হাতে বিদ্যুৎ বিলের কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘মোটা হয়ে যাচ্ছিস। গতরটা একটু নাড়াচাড়া কর। ব্যাংকে গিয়ে বিলটা জমা দিয়ে দে।’

বিল্লাল নাস্তা শেষ করে মোবাইল হাতে নিল। মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল অ্যাপ খুলে কয়েকটা ক্লিক করল। স্ক্রিনে ভেসে উঠল—‘আপনার বিল পরিশোধ সম্পন্ন হয়েছে।’

চায়ের কাপ হাতে চুমুক দিতে দিতে বসে পড়ল। বাবা আবার বললেন, ‘তাড়াতাড়ি যা। নাহলে ব্যাংকে বড় লাইনে দাঁড়াতে হবে।’ বিল্লাল বলল, ‘হয়ে গেছে, বাবা। মোবাইল দিয়েই এসব দেওয়া যায়।’

আশরাফ ভাবলেন, ‘এক সময় এসব বিল পরিশোধ করতে তাকে ব্যাংকে বা পোস্ট অফিসে নগদ হাতে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা লাগত। অনেক সময় ফরম ভুল পূরণ হলে বা কাগজপত্র ঠিক না থাকলে আবার নতুন করে কাজ করতে হতো। কখনো আবার শুনতে হতো, ‘আজ আর বিল নেওয়া হবে না, কাল আসুন।’ মাস শেষে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হওয়ার ভয় নিত্যসঙ্গী ছিল।

বিল্লাল বলল, ‘এখন অনেকগুলো মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস আছে। শুয়ে বসে হাতে মোবাইল নিয়ে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, টেলিফোন—সব বিল পরিশোধ করা যায়। সময়ৎ বাঁচে, ঝামেলা নেই।’

আশরাফ বললেন, ‘শহরের কথা ঠিক আছে। কিন্তু গ্রামে কিভাবে হয়?’ বিল্লাল বলল, ‘গ্রামেও ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে ডিজিটাল সেন্টার আছে। সেখানে পল্লী বিদ্যুৎ বিল দেওয়া যায়। পাঁচ টাকায় কাজ শেষ। দূরে কোথাও যাওয়া লাগে না।’

২০১৮ সালের পর থেকে পরিস্থিতি বদলেছে। মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস যেমন বিকাশ, নগদ, উপায়—এসব ছড়িয়ে পড়েছে। তারপর এলো জাতীয় বিল ও সার্ভিস এগ্রিগেটর একপে (EkPay)। এই এক প্ল্যাটফর্ম থেকে সরকারি বিল, ফি সবকিছু পরিশোধ করা যায়: বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, টেলিফোন, ইন্টারনেট, স্কুল-কলেজের ফি, ভূমি উন্নয়ন কর—সব। সব সেবা একসাথে। মোবাইল ব্যাংকিং, ইন্টারনেট ব্যাংকিং, ক্রেডিট কার্ড—যেটা সুবিধা, সেটা দিয়ে পেমেন্ট করা যায়।

উল্লেখযোগ্য সেবাগুলোর মধ্যে আছে:

  • বিদ্যুৎ বিল: ডিপিডিসি, ডেসকো, পল্লী বিদ্যুৎ, ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ইত্যাদি।

  • গ্যাস বিল: তিতাস গ্যাস, কর্ণফুলি গ্যাস, সুন্দরবন গ্যাস ইত্যাদি।

  • পানি বিল: ঢাকা ওয়াসাসহ অন্যান্য পৌরসভার পানি বিল।

  • টেলিফোন বিল: বিটিসিএলসহ ল্যান্ডলাইন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিল।

  • ইন্টারনেট ও টিভি বিল: বিভিন্ন আইএসপি ও ক্যাবল টিভি সেবার বিল।

  • শিক্ষা ও সরকারি ফি: স্কুল-কলেজের টিউশন ফি, পাসপোর্ট ফি, ট্রেড লাইসেন্স ফি, ভূমি উন্নয়ন কর।

  • অন্যান্য সেবা: জন্মনিবন্ধন ফি, হোল্ডিং ট্যাক্স, পোর্ট ফি, প্যাসেঞ্জার ফ্যাসিলিটি চার্জ ইত্যাদি।

ডিজিটাল বিল পেমেন্টের প্রভাব:

  • কর্মঘণ্টা বেড়েছে

  • নগদ টাকা বহনের ঝুঁকি কমেছে,

  • উৎপাদনশীলতা বেড়েছে

  • আর্থিক অন্তর্ভুক্তি সম্প্রসারিত হয়েছে

এখনো যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে:

  • ইন্টারনেট সংযোগের ঘাটতি,

  • বয়স্ক এবং প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষতার ঘাটতি

এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সচেতনতা কার্যক্রম, প্রশিক্ষণ প্রদান, ইন্টারনেট অবকাঠামো উন্নয়ন চলছে।

0
Subscribe to my newsletter

Read articles from mohammad faisal Haidere directly inside your inbox. Subscribe to the newsletter, and don't miss out.

Written by

mohammad faisal Haidere
mohammad faisal Haidere